পুনঃ নবজাগরণ
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জন্মবর্ষ কে জ্ঞানী-গুণিরা বলেন," বাংলার নবজাগরণের সুবর্ণবর্ষ।" তবে সত্যধর্ম্ম বিশ্বজগতে প্রথম প্রকাশের বর্ষকে কি বলা উচিৎ। মহাত্মা গুরুনাথের জন্মবর্ষকেই বা কি বলা প্রয়োজন ছিল ? রবীন্দ্রনাথের জন্ম, সত্যধর্ম্ম প্রথম প্রকাশ, মহাত্মা গুরুনাথের জন্ম --- তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই কিন্তু বাংলার রেনেসাঁর একদম চুড়ান্ত শীর্ষ সময়ে সংগঠিত হইয়াছিল। তাহা হইলে এই বঞ্চনা কেন? তবে নেই কেন স্বীকৃতি? এখান থেকেই সুস্পষ্ট বোঝা যায়, বর্তমান বাঙালী কেন তার পুরানো গৌরব হারিয়েছে। আসলে পাপ কাহাকেও রেহাই দেয় না।
বাঙালি কখনও ইতিহাস সচেতন নয়। বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ক্ষুদ্র অংশ সত্যধর্ম্ম বহন করিয়া যুগ হইতে যুগান্তরে লইয়া যাইতেছেন, তাঁহারা ইতিহাস সম্পর্কে আরও নিস্পৃহ। সত্যধর্ম্ম বর্তমানে যে স্বর্ণযুগের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হইতেছে তাহাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নাই কিন্তু বাঙালী গুরু ভাইবোনের উহা বোধগম্যের বাইরে। বর্তমান আদিষ্ট সাধকের কাজের ধারা লক্ষ্য করিলে প্রমাণিত হইবে এই স্বর্ণযুগ। পুরাতন আবর্জনা, জড়তা, আড়ষ্টতা দূরে নিক্ষেপ করিয়া, স্বর্ণযুগ তার নিজের চলার পথে, গতি বৃদ্ধি করিয়া লইতেছেন। গতিই জীবন, গতি হীনতাই মৃত্যু।
সমাজ-সভ্যতার চরম নৈরাজ্য ও অরাজকতার সময়েই চরম উৎকৃষ্টতার সৃষ্টি হয়। ইহাই বাস্তব, তাই ইহা সত্য --- পরমেশ্বরের আইন।পরমপিতা মঙ্গলময় তিনি অনন্ত কালেও অমঙ্গল বিধান করেন না, গুরুদেব বলিয়াছেন, "অমঙ্গল রাশি হতে, সুমঙ্গল বিধিমতে, সদা জনমে জগতে, মঙ্গল ভাবেতে তাঁর।" সুতরাং এতগুলি দল হইবার কারণ এখন স্পষ্ট হইতেছে যে, সকলের মধ্যে মন্থনের প্রয়োজন হইয়াছিল, এই মন্থনের জন্যই আজ সত্য রূপ মাখন স্বরূপ অমৃতের আস্বাদন করিতে পারিতেছি, সুতরাং পরমপিতাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
একটু মনোনিবেশ সহকারে দৃষ্টিপাত করিলে লক্ষ্য করা যাইবে যে, এতো গুলি ছোট ছোট দল, উপদল পূর্বে কখনো সত্যধর্ম্মে হয় নাই। দমবন্ধ করা অসহিষ্ণুতা নিজের ঘরের জল, আলো, বাতাসকে বিষাক্ত করিয়াছে । কেহ কাহার কথা শুনিতে পারা দুরের কথা, দেখিতে পর্যন্ত পারে না। এতো হিংসা, ধৈর্যহীনতা, তাহার উপর পড়াশোনাও তথৈবচ। উপাসনা পদ্ধতি নিয়ে কম কাঁদা ছোড়াছুড়ি হয়নি। আরও অনেক কারণ আছে, তাহার বিস্তারিত আলোচনা করিলে নিশ্চিত রূপে লক্ষ্য হইতে বিচ্যুত হইব। অপগুণ বৃদ্ধি করিবার জন্য সাধনার প্রয়োজন নাই , কেবলমাত্র নিজেকে স্রোতে ভাসিয়ে দিলেই হইবে। যৎসামান্য কিছু কারণ নিম্নে বর্ণিত হইল।
প্রকৃত পক্ষে কেবলমাত্র গুটি কয়েক গুরু ভাইবোনের মধ্যে দৃষ্টি গণ্ডিবদ্ধ রাখিলে, আমাদের এই ন্যাজে-গোবরে অবস্থা হইতে উত্তরণ হওয়া তো দুরের কথা, বাইরের বিশ্বজগতের সাপেক্ষে নিজেদের অবস্থান পর্যন্ত সঠিক ভাবে বুঝিয়া উঠিতে পারিবনা। এই কারণে গুরু ভাইবোনদের ছোট্ট গণ্ডির বাইরে বিরাট বিশ্বজগতের দিকে যত্নসহকারে দৃষ্টি রাখা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বের অন্যান্য বৃহৎ জনসংখ্যার ধর্ম গুলির মতাদর্শ গত অবস্থান কি ? তাহাদের আন্তঃসম্পর্কে আন্তরিকতার তলানি ও তীব্র দ্বন্দ্বের ধর্মীয় কাঠামো গত চরিত্র কি ? ধর্মীয় দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিমূখ কোন দিক নির্দেশ করিতেছে ? বোঝাবুঝি পরিস্কার করিতেই হইবে নতুবা সত্যধর্ম্ম প্রচার হইবে না বরং ভীষন বাধাপ্রাপ্ত হইবে।
উপাসনা পদ্ধতি মহাত্মা গুরুনাথ নিজে হাতে উপাসনা পুস্তকের চতুর্থ অধ্যায়ের শেষ পর্যায়ে লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। তৎসত্ত্বেও অন্ধের মতো , আমরা গুরুদেবের লেখনী অমান্য করিয়া, ধ্যান ও অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়া উপাসনা শুরু করিয়া নিজেদের আত্ম-উন্নতি রুদ্ধ করিলাম। মূল সত্যধর্ম্ম পুস্তকে যে উপাসনা পদ্ধতি পারলৌকিক মহাত্মাগন দিয়াছেন, তাহাই অন্তিম নির্যাস। ঐ উন্নত পর্যায়ে পৌঁছাইতে, প্রথমে উপাসনা পুস্তকে গুরুদেব লিখিত উপাসনা পদ্ধতি অনুসরণে ক্রম উন্নতি করিয়া, পরিশেষে সত্যধর্ম্ম পুস্তকে পারলৌকিক মহাত্মাগন দ্বারা উল্লেখিত উন্নত উপাসনা পদ্ধতিতে পৌঁছান সম্ভব। এই কারণে মহাত্মা গুরুনাথ সাধারণের জন্য যে উপাসনা পদ্ধতি উপাসনা পুস্তকে লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন, তাহা বাদ দিয়া উন্নতি অসম্ভব।
মাটির কাছাকাছি তৃনমূল স্তরে জাত-পাত একটি ভীষণ বিষাক্ত নোংরা বিষয় হওয়া সত্ত্বেও শ্রেণীবিভাগ সত্য,শাশ্বত ও আত্ম-উন্নতি পরিমাপক, তাহা পূর্বে আমার কাছে স্বচ্ছ ছিল না। জাত-পাতের আড়ালে অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাগ তথা গুণের শ্রেণীবিভাগ এক চরম বাস্তব সত্য। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য ও শূদ্র অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ্যতাবাদ, সত্যধর্ম্মও স্বীকার করে। পার্থক্য এইটুকু যে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যতাবাদ সাকার স্থূল বংশবাদী কিন্তু সত্যধর্ম্মে জাত-পাত নিরাকার পূর্ণগুণে প্রতিষ্ঠিত।তথাকথিত বংশবাদী ব্রাহ্মণ গুণহীন হইলে অস্পৃশ্য হইবে, বিপরীতে মুচী গুণে উন্নত ব্রহ্মদর্শী হইলে, তিনি প্রকৃত মর্যাদা সম্পন্ন ব্রাহ্মণ হইবেন। ইহাই প্রকৃত সত্যধর্ম্ম।
সর্ব্বশক্তিমান পরমপিতার নির্দেশ এই যে, আপাতত নিম্ন শ্রেণীর মধ্য দিয়া সত্যধর্ম্ম প্রচারিত হইবে। মহাত্মা গুরুনাথ গৈলানিবাসী বৈকুণ্ঠ দাশ মহাশয় কে চিঠিতে লিখিয়াছিলেন যে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের একজন শীঘ্রই সত্যধর্ম্মে আসিবেন, যাহার দ্বারা সত্যধর্ম্মের প্রভুত কাজ হইবে। তিনি হলেন স্বয়ং মহাত্মা নিবারণ। সমাজের নিম্ন-স্তর হইতে সংস্কার শুরু করিতে হয়, ইহাই পরমেশ্বরের বিধান।
প্রকৃত-পক্ষে সত্যধর্ম্মের আবিষ্কারক ছিলেন প্রেমবৃত্তের মোট উনিশ (১৯) জন সদস্যের মধ্যে পাঁচ (৫) জন উচ্চবর্ণের মানুষ। ইহা বাস্তব সত্য যে, কোনো নিম্ন বর্ণের মানুষ ঐ প্রেমবৃত্তে স্থান অধিকার করিয়া লইবার যোগ্যতা অর্জন করিতে পারেন নাই। ইহাতে নিম্ন নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের বিন্দুমাত্রও হীনমন্যতার কোনো কারণ নাই, কারণ উহার প্রতিকার স্বরূপ সর্ব্বশক্তিমান আমাদের সত্যধর্ম্ম প্রদান করিয়া কৃতার্থ করিয়াছেন।
নিম্ন নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের বাস্তব উন্নতি রুদ্ধ করিবার জন্য উচ্চ বর্নের মহাত্মা সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের দলবল উপাসনা পদ্ধতি হইতে ধ্যান সহ অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়ে দিলেন। দায়ভার মহাত্মা নিবারণের উপর চাপাইলেন। এই রূপ ভয়ঙ্কর হিংস্র জাতি বিদ্বেষ পৃথিবীতে এক বিরল ঘটনা। এই সময় হইতেই সত্যধর্ম্মের অবক্ষয় শুরু হইল।
বেন্দা গ্রামের যে গৃহে মহাত্মা গুরুনাথ শেষ দিন পর্যন্ত বসবাস করিয়াছিলেন, অধিকাংশ গুরুভাই বলেন, ঐ গৃহভীটাই গুরুদেবের জন্মভূমি। না, এ তথ্য সম্পূর্ণ ভুল।
সাধু রমানাথ নিকট আত্মীয়দের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে পৈতৃক ভিটামাটি ছাড়িয়া রাস্তায় ঠাঁই নিলেন। সঙ্গে জীবন সাথী গৌরী দেবী ও সংসার বুদ্ধিহীন সরল ছোট ভাই গোলোকনাথ। অসহায় নির্বান্ধব মহাত্মা রামনাথ কে সাহায্যের হাত বাড়াইয়া দিলেন, ঐ একই বেন্দা গ্রাম নিবাসী মহান মদনমোহন দাশগুপ্ত মহাশয়। বেন্দায় নিজ গৃহে আশ্রয় দিলেন রামনাথ কে এবং পরবর্তীতে ঐ গৃহে জন্ম নিলেন মহাত্মা গুরুনাথ, মহীমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র ও কামিনীরঞ্জন নামে ব্রহ্মদর্শী সত্যধর্ম্ম সাধকগণ। ফলে ইহা প্রমাণিত যে বেন্দায় অবস্থিত সত্যধর্ম্ম আশ্রমের জমি মহাত্মা গুরুনাথের পবিত্র জন্মভূমি নয়। আসল জন্ম ভিটার খোঁজখবর আমাদের কাছে নাই।
গুরুদেবের প্রকৃত বাসভূমি নদী ভাঙ্গনের কারণে বহু দিন পূর্বে কালিন্দী নদী গর্ভে বিলীন হইয়াছে। ঐ পূণ্য বাসভূমি ফিরিয়া পাইবার আর কোন আশা নাই।
গুরুদেবের বাসভূমি নদী গর্ভে বিলীন হইবার বেশ কিছু দিন পরে, ঐ বেন্দায় নতুন চর নদী হইতে উৎপন্ন হয়। গুরুভাই-বোনেরা ঐ নতুন চরকে গুরুদেবের বাসভূমি বলিয়া অধিকার করেন এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে দেবত্তর সম্পত্তি হিসেবে আবেদন করেন। কিন্তু সরকার বলিয়াছিলেন, কোন দেবতার সম্পত্তি হিসাবে আপনারা এই নতুন জেগে ওঠা জমি অধিগ্রহণ করিতে চাইছেন? আমরা সত্যধর্ম্ম ও তার প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গুরুনাথ কে জানিনা, চিনি না। সুতরাং ঐ নামে দেবত্তর সম্পত্তি ঘোষণা করা যাইবে না। আপনারা এমন কোন ব্যক্তির উল্লেখ করিতে পারেন যাহার সামাজিক পরিচিতি আছে।" ফলে গুরু ভাই-বোনেরা গুরুদেবের গুরু মহাত্মা শিবের মিথ্যা কল্পিত মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ঐ জমি দেবত্তর সম্পত্তি হিসাবে অধিকার সরকারের নিকট হইতে স্বকৃতি আদায় করেন। সুতরাং বলাযায় যে বেন্দায় প্রতিষ্ঠিত আশ্রম আসলে মিথ্যা কে আশ্রয় করিয়া প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।
সত্যধর্ম্ম অনুযায়ী স্থূলদেহধারী স্ত্রীলোক দীক্ষা দিতে পারেন না বা দীক্ষা দওয়া নিষেধ। এই কথা কটি মহাত্মা গুরুনাথ, সত্যধর্ম্ম পুস্তকের শেষে গূরুতত্বে লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন।
প্রেমের অধিবেশনে কাম্য বিষয়ক কোন কিছু পরমপিতার নিকট চাওয়া যায় না। এমন কি দয়া, কৃপা, করুনা শব্দ গুলির ব্যাবহার পর্যন্ত করা যায় না। স্বীয় পাপ উল্লেখের স্থানে, প্রেম হীনতা হেতু আত্মগ্লানি ভোগ করিতে হইবে।
একমাত্র আদিষ্ট সাধকের উৎসব ভিন্ন সকল উৎসবে মহাত্মা গুরুনাথের ছবি সম্মুখে রাখিয়া পরমপিতার উপাসনা হয়। ইহা অত্যন্ত পাপকর কার্য্য। গুরুদেব স্থূল দেহে জীবিত থাকাকালীন নিজের ছবি সম্মুখে রাখিয়া উপাসনা করিতে না সুতরাং আমরাও করিব না। তাহাছাড়া বাইরের মানুষ প্রথম আসিয়া মনে করে যে আমরা ঐ ছবিকে পরমেশ্বর রূপে পূজা করিতেছি।
সর্ব্বসিদ্ধি শান্তিদাতা জগৎ গুরুনাথের জয় জয় জয়। শান্তিদাতা সুখদাতা দুঃখহারী গুরুনাথের জয় জয় জয়।।
উপরে উল্লেখিত গুণকীর্তন কখনো গুরুদেবের নহে, কারণ গুরুদেব কখনো সর্ব্বসিদ্ধি দাতা নহেন। তিনি জগৎগুরুও নহেন। গুরুদেব বলিয়াছেন, "গুরুনাথ নাথ তুমি, গুরু হে আমার"--- এখানে "গুরুনাথ" বলিতে গুরুদেব নিজের কথা বলেন নাই, পরপিতার কথা বলিয়াছেন। তিনবার (৩) জয়ধ্বনি একমাত্র পরিপিতাকে দেওয়া যায়। সুতরাং কি মহাপাপে আমরা লিপ্ত হইতেছে --- একবারটি ভাবিবেন না?
সত্য সনাতন পতিত পাবন।
নিত্য নিরঞ্জন বিভু জয় জয়।।
সত্যসনাতন কীর্তন টি পাপ হইতে মুক্তির জন্য কিন্তু তাহাতে যদি কেহ অজ্ঞানতার কারণে ধেই ধেই করিয়া নাচে তাহাতে পাপ আরো বাড়ে। উৎসবে উপাসনা চলাকালীন নাচিয়া-নাচিয়া গুরুদেবের ছবিতে আরতি করিতে করিতে গুণ কীর্তনটি করিলে, গুরুদেবকে পরমেশ্বরের আসনে বসাইবার দরুন ঘোরতর পাপে পতিত হইতে হয়। এই পাপকর কার্য্য আমাদের স্থান ভিন্ন সর্বত্র হইতেছে।
উপাসনায় কোন যুক্তিতে নাচা-গানা করা যাইতে পারে তাহা আমার জানা নাই। কেবলমাত্র স্থূল ফুর্তি ইহার যুক্তি হইতে পারে, একাগ্রতা নয়। তাহাও আবার গুরুদেবের ছবি আরতি করিতে করিতে। চেতনায় নাই যে গুরুদেব পরমপিতা নহেন। সুতরাং উহা বর্তমানে নিম্ন স্থূলের স্থূল রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে।
সত্যধর্ম্মীরা নিরাকারের উপাসক। অন্ধ সাকার বা কল্পিত মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করে না। মহাত্মা গুরুনাথ বলিয়াছেন, " তোমরা আমাকে পরমেশ্বর জ্ঞানে কখনো পূজা করিও না, করিলে তোমাদের পাপ হইবে।" এর পরেও কখনো আমরা গুরুদেব-এর ছবি সামনে রাখিয়া, পরমপিতার উপাসনা কিছুতেই করিতে পারিনা। এর পরেও যদি কেহ ছবি সম্মুখে রাখিয়া উপাসনা করেন, তবে তাহার আত্ম-উন্নতি হইবে না।
গুরুদেব বলিয়াছেন," সুক্ষ্ম পূজাই প্রধান, আরও বলিয়াছেন, "সত্যধর্ম্মাবলম্বীদের গুরু পূজা ভিন্ন আর কাহারও পূজা করিবে না" এবং এহেন বলিয়াছেন, কল্পিত ছবি মূর্তি অপসারণ পূর্বক নিরাকার পরমপিতার উপাসনা একমাত্র কার্য্য।"তাহা হইলে গুরুদেবের বাক্য অমান্য করিয়া ঘরে ঘরে এবং উৎসবে কল্পিত দেবদেবীর ছবি ব্যাবহার এখনও হইতেছে। গুরুদেব বলিয়াছেন," গুরু কে সর্ব্বপরি রাখিতে হয়।"
দেখ, নিরাকার-বাদ প্রচলিত করিবার জন্য যিনি যতই চেষ্টা করুন না কেন, কালে উহা সাকারবাদে পরিণত হয়। গুরুদেব সাকার বাদ মানিতেন না সত্য, কিন্তু তাঁহার পরবর্ত্তিগণ (শিষ্য-প্রশিষ্যেরা) বেশীরভাগ নিজের অগোচরে সাকারবাদী হইয়া পড়িয়া ছিলেন। কারন গুরুদেবের পূজাই এই সাকার-বাদের মূল। অবশ্য, গুরুদেব কে গুরুদেব বলিয়া পূজা করিলে সাকার বাদ হইত না কিন্তু তাঁহাকে পরব্রহ্মের আসনে অধ্যাসীন করাতেই সাকার বাদ ঘটিয়াছে। নতুবা, পিতাকে পিতা বলিয়া, মাতাকে মাতা বলিয়া, গুরু কে গুরু বলিয়া এবং দেবতাকে দেবতা বলিয়া পূজা করিলে কোনো দোষ হইতে পারে না। মহাত্মা গুরুনাথের ছবি রাখিয়া পূর্ণ ব্রহ্মের উপাসনা করিলে নানা বিধ দোষ জন্মে এবং উহাই সাকার-বাদের প্রকৃত দোষ। প্রবর্ত্তক গুরুদেব ভিন্ন সকল সত্যধর্ম্মীর বাড়িতে বাড়িতে ও উৎসবে এই ভীষণ পাপ হইতেছে।
উপাসনাই বল, উপাসনায় শান্তি, উপাসনা ব্যাতীত সত্যধর্ম্মে থাকিবার আর কোনো উপায় নাই। পারলৌকিক মহাত্মাগণ বলিয়াছেন যে, সত্যধর্ম্মে কেবলমাত্র থাকিতে হইলে তিন ঘণ্টা (১৮০ মি) উপাসনা করিতেই হইবে।
সেখানে কেহ উপাসনার সময় সঙ্কুচি করিয়া মাত্র ১ঘন্টা ৪০মি (১০০মি) করিয়াছেন। উপাসনা ও গুরুপূজা একসাথে করিয়া সময় কমানোর এক কদাকার জগাখিচুড়ী সৃষ্টি করিয়াছেন। সত্যধর্ম্ম মুছিয়া ফেলিবার চমৎকার উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছেন।
অবিরাম শাস্ত্র পাঠে ভুল ব্যাখ্যা করিয়া সত্যধর্ম্ম হইতে মানুষ কে দুরে সরাইয়া দেওয়া হইয়াছে। এতদিন কেহ সাহসীকতার সহিত বলেননাই যে, "সত্যধর্ম্মীদের মিথ্যা কাল্পনিক দেবদেবীর ছবি, মূর্তি পূজা করা নিষিদ্ধ। দেবদেবীর মূর্তি দর্শন তো দুরের কথা, প্রনাম পর্যন্ত করা নিষিদ্ধ।"
প্রবর্ত্তক গুরুদেব পুনরায় গুরুদেবের লিখনি পুনঃ প্রতিষ্ঠা করিয়া গুরু গম্ভীর আকাশবাণী করিলেন, "সত্যধর্ম্মীরা হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, খৃষ্টান নয় বা অন্য কোন তথাকথিত ধর্মী নয়। সত্যধর্ম্মীরা হইলেন "সত্যেষ্ট"।"কারন সত্য যাহার একমাত্র ঈষ্ট তিনিই সত্যেষ্ট। যেমন যে কোন ধর্ম্মাবলম্বী গণ ধর্ম্ম শব্দ যুক্ত করিয়া তাহাদের পরিচয় ব্যাক্ত করেন না।
কোনও স্ত্রী দীক্ষা প্রদান করিলে তাহাকে আমরা গুরুদেবী বলিলে তাহার স্বামীকে নিশ্চয় গুরুদেব বলিব না। সুতরাং গুরুদেবের স্ত্রীকে গুরুমা বা গুরুদেবী বলা যায়না। বলিলে পাপ হয়।
ইদানিং কালে বাংলাদেশ হইতে নাম ও দীক্ষা এক বলিয়া প্রচার চলিতেছে। ইহা কালিদাসের গাছের ডাল কাটিবার ন্যায় নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বহন করিতেছে। "দীক্ষা" একমাত্র একত্ব প্রাপ্ত ব্রহ্মদর্শী সাধক প্রদান করেন। "নাম" যে কেউ সত্যধর্ম্ম গ্রন্থ হইতে দিতে পারেন।
ইংরাজী ২০১১-খৃষ্টাব্দের একদম শেষদিকে কল্যাণী শিশিরোৎসব চলিতেছে। উৎসব-প্যাণ্ডেল গুরু ভাইবোনদের সমাগমে পরিপূর্ণ। খণ্ডিত ভারতবর্ষে তখনও কংগ্রেস পার্টির শ্রী মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী পদে টিমটিম করিয়া জ্বলিতেছে। আর ঠিক সেই সময়ে দেশে বিদেশে চিন্তা জগতে একটি মহা প্রলয় ও আলোড়ন চলিতেছে --- ধর্ম্ম, সমাজ, সভ্যতা, সাহিত্য, রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সব কিছুতেই মানুষ নতুন করিয়া ভাবিতেছে। ভারত-পথিক, ভারত আত্মা, ভারতের নবজাগরক রাজর্ষি রামমোহন রায় হিন্দু ধর্ম কে আর্য্য বেদান্ত প্রতিপাদ্য ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়া ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন কিন্তু তবু চতুর্দিকে নতুনে-পুরাতনে তীক্ষ্ণ হিংসা প্রকট হইয়া বিশাল 'হা' করিয়া বিশ্ব-মানব সভ্যতাকে গিলিতে উদ্যত হইয়াছে। ধর্ম্ম জগতে যেন এক মহা-সন্ধিক্ষনের সম্মুখে উপস্থিত। দর্শন ও বিজ্ঞানের চিরকালের দ্বন্দ্ব ক্রমে উগ্রমূর্ত্তি ধারন করিয়াছে। আধুনিক ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞান পরিপুষ্ট মানুষ উদার মতাদর্শের সহিত, প্রাচীন ধর্মের বিরোধ চলিতেছে। সত্য ও ধর্ম্ম পিপাসু মানুষের চিত্ত সত্যধর্ম্ম লাভ করিবার জন্য ব্যাকুল ও উন্মুখ হইয়া আছে। আর এই ধর্ম্মের মহা-সন্ধিক্ষনে সত্যযুগ প্রবর্ত্তক মহাত্মা গুরুনাথ ধরাধামে অবতীর্ণ হইলেন। নরনারীর এতো আকুতির ফলে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, একমাত্র সুত্র তথা মতাদর্শ, যাহা সত্যধর্ম্ম নামে পরিচিত, তাহা বিশ্বজগত প্রাপ্ত হইল। মানব জাতির ইহা অপেক্ষা সুখের ও আনন্দের প্রাপ্তি আর হইতে পারে না,অথচ আমাদের ৪৮ বৎসরের ব্যার্থতার কারণে সত্যধর্ম্ম প্রচারের উদ্দেশ্য সফল হয় নাই। ফলে মহাত্মা নিবারণের মৃত্যু কাল হইতে ২০১১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ্য ৪৮ বৎসর যাবৎকাল কোন আদিষ্ট সাধক সত্যধর্ম্মে আবির্ভূত হয় নাই। সত্যধর্ম্মের মূল theory বা সুত্রের কাজ মহাত্মা গুরুনাথ করিয়া গিয়াছিলেন কিন্তু বর্তমান আদিষ্ট সাধক সত্যধর্ম্মের বাস্তব, হাতেনাতে স্থূল Practical বা প্রচারের কাজ করিতেছেন। এই কারণে তিনি এতো রুক্ষ, কঠোর সত্যবাদী। ইহার কারণ এই যে তিনি সর্ব্বপ্রথমে কঠোর সত্য গুণে একত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিলেন অর্থাৎ ব্রহ্মদর্শন করিয়াছিলেন। আদিষ্ট সাধক, এই কারণে, প্রখর রৌদ্রুই হোক, আর মুষলধারে বৃষ্টিই হোক, অথবা কনকনে তীব্র শীতই হোক, তিনি কঠোর সত্য গুণে নির্ভর করিয়া, কঠোর পরিশ্রমে নাঙ্গল লইয়া মাটি চাষ করিতে, মাঠে নামিয়া পড়েন তৎক্ষনাৎ।
সত্যধর্ম্ম মতাদর্শ অনুযায়ী অধিবেশন ও উৎসব এক নহে। উৎসব ক্ষেত্র হইল অবারিত দ্বার, উৎসবে প্রবেশ অধিকার কাহারও নিষিদ্ধ নহে। কিন্তু অধিবেশন তাহা নহে। গুরুদেব জীবিত থাকাকালীন তিনি অধিবেশন করিতেন। অধিবেশন ১৫ দিন হইতে শুরু করিয়া সর্ব্বচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত হইত।
বর্তমান প্রবর্ত্তক গুরুদেব ঈশ্বর রনজিৎ হালদার দেড় বৎসর যাবৎ বিভিন্ন সাপ্তাহিক উপাসনা ও উৎসবে জোরদিয়া বলিতেছিলেন," গুরুদেব! তিনটি, এক মাসের অধিবেশন করিবার জন্য আদেশ করিয়াছেন কিন্তু কোথায়, কখন, কিভাবে হইবে তাহা কিছুই জানাননি।" সৎসতীগন শুনিয়া তাহাদের মাথায় বজ্রাঘাত হইল এবং তাঁহারা এই উদ্ভট গল্প একদম বিশ্বাস করিলেন না। চন্দন বলিয়াই বসিলেন, "প্রবর্ত্তক গুরুদেব! আপনি একা একা অধিবেশন করিবেন,আর কেহই আসিবে না।" সভাপতি বলিলেন," অসম্ভব! আমি অফিসে ৩০ দিনের ছুটি তো দুরের কথা, ১ দিনের ছুটি পর্যন্ত পাই বহু কষ্ট করিয়া।"
কিন্তু আমরা কল্পনাও করিতে পারিনাই যে, গুরুদেব আদিষ্ট, ঐ অসম্ভব অধিবেশনের সকল প্রকার প্রধান ও মূল দায়িত্ব গ্রহণ করিলেন পারলৌকিক মহাত্মাগন, সুতরাং অধিবেশন বর্তমানে মধূৎসব হইতে ৬৯ দিন সুন্দর ভাবে সুসম্পন্ন হইতেছে এবং গুরুদেবের অমোঘ দৈববাণী অনুসারে ৯০ দিন পর্যন্ত চলিবে। পূর্বে প্রশ্ন উঠিয়াছিল, এত বড়ো কাজের ব্যায়ভার কে বা কাহারা বহন করিবেন কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে আমাদের কোন ব্যায়ভার বহন করিতে হইল না। বুঝুন গুরুদেব আমাদের কতো ভালোবাসেন।
এখন স্মরণে আসিতেছে, তখন গুরত্ব দিতে পারি নাই --- প্রবর্ত্তক গুরুদেব কেন ঘন্টার পর ঘন্টা "গুণ" বাছিয়া বাছিয়া, বহু সংখ্যক গুণের উপাসনা নির্ধারণ করিতেছিলেন। আর মৃদু হাসিয়া বলিতেছিলেন, "আমার ইচ্ছা ১৫০ টি অধিবেশন চুড়ান্ত করিবো, কতটা পারিব বলিতে পারিতেছি না।এখন বুঝিতে পারিতেছি, এ সকলই গুরুদেব আদিষ্ট ১ মাসের অধিবেশনের উদ্দেশ্যে পূর্ব পরিকল্পিত রূপে করা হইয়াছিল এবং সেই মহান অধিবেশন এখনও অবিরাম ধারায় চলিতেছে।
সভাপতি
শ্রী অচিন্ত্য মণ্ডল
১৮/০৬/২০২০
গুরুনাথ সত্যধর্ম্ম মহামণ্ডল কেন্দ্র
0 Comments